
আলী আহসান রবি : আজ বিকেল ৩:০০ টায় ফরেন সার্ভিস একাডেমি প্রাঙ্গণে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), মহেশখালী সমন্বিত উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (মিডা)-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান এবং পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটি (পিপিপিএ)-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদা) জনাব আশিক চৌধুরী বলেন-
বাংলাদেশের বন্দর খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ)। প্রতিষ্ঠানটি ডেনমার্কভিত্তিক মায়ের্সক গ্রুপের (Maersk Group) সম্পূর্ণ মালিকানাধীন সহযোগী প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালস বি.ডি. (APM Terminals B.V.)-এর সঙ্গে একটি ৩০ বছরের কনসেশন চুক্তি স্বাক্ষরের পথে রয়েছে, যার ফলে তারা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কাঠামোর আওতায় লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল (এলসিটি) প্রস্তুত ও পরিচালনা করবে। এপিএম টার্মিনালস এই প্রকল্পে ডিজাইন, ফাইন্যান্স, বিল্ড এবং অপারেট করবে, তবে বন্দরটির মালিকানা থাকবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনে। এর ফলে সরকারের মূলধনী ব্যয় (Capital Expenditure) উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে।
এপিএম টার্মিনালস বি.ভি. সম্পূর্ণরূপে মায়ের্সক গ্রুপের মালিকানাধীন, যার সদর দপ্তর ইউরোপের অন্যতম শীর্ষ দেশ ডেনমার্কে, যা বিশ্বে দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে এক নম্বরে অবস্থান করছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যনুসারে (২০২৪) প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ৩৩টি দেশে ৬০টির বেশি টার্মিনাল পরিচালনা করছে এবং বিশ্বের শীর্ষ ২০টি বন্দর-এর মধ্যে ১০টি বন্দরের অপারেটর করে আসেছে। শুধু ইউরোপ নয় এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন চীন, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে তাঁদের বন্দর পরিচালনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে এই প্রকল্প বাংলাদেশে বিশ্বমানের প্রযুক্তি, দক্ষতা ও কার্যকারিতা নিয়ে আসবে।
লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল হবে দেশের প্রথম গ্রীন ও স্মার্ট পোর্ট, যা বর্তমান সক্ষমতার দ্বিগুণ আকারের জাহাজ ধারণ করতে পারবে এবং ২৪ ঘণ্টা নাইট ন্যাভিগেশন সুবিধাসহ পূর্ণমাত্রায় পরিচালিত হবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরাসরি বৈশ্বিক শিপিং সংযোগ পাবে এবং রপ্তানিকারক ও আমদানিকারকদের জন্য পরিবহন ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে।
এর ফলে যে সব সুবিধাসমূহ বাংলাদেশ প্রাপ্ত হবে তা হলো;
১. বৃহৎ বৈদেশিক বিনিয়োগ (FDI): চুক্তির আওতায় এপিএম টার্মিনালস পুরো মেয়াদকালে ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করবে, যা হবে বাংলাদেশে এককভাবে সর্ববৃহৎ ইউরোপীয় ইক্যুইটি বিনিয়োগ।এপিএম টার্মিনালের মতো একটি বিশ্বমানের বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে আগমন করলে তা দেশের অন্যান্য খাতে অতিরিক্ত বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) আকৃষ্ট করবে।
২. কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বৃদ্ধি: এলসিটি চালু হলে বন্দরটির কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা ৮ লক্ষাধিক টিইইউ
(TEU) প্রতি বছর বৃদ্ধি পাবে, যা বর্তমান সক্ষমতার তুলনায় প্রায় ৪৪% বেশি। টার্মিনালটি ২০৩০ সালের মধ্যে চালু হওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
৩. সরকার ও সিপিএ’র আয় বৃদ্ধি। প্রকল্পটি রাজস্ব ভাগাভাগি ভিত্তিতে পরিচালিত হবে, যার মাধ্যমে সিপিএ প্রতি কনটেইনারে নির্দিষ্ট ডলার-নির্ভর রাজস্ব পাবে। একই সঙ্গে কর, শুল্ক এবং সামুদ্রিক আনুষঙ্গিক সেবার মাধ্যমে সরকারের আয়ও বাড়বে।
৪. কর্মসংস্থান: এই প্রকল্পের নির্মাণ ও পরিচালনা পর্যায়ে ৫০০-৭০০ জন সরাসরি কর্মসংস্থান এবং ট্রাকিং, স্টোরেজ, লজিস্টিকস ও স্থানীয় এসএমই খাতে কয়েক হাজার পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
৫. আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা ও কার্যপদ্ধতি: এপিএম টার্মিনালস বিশ্বমানের হেলথ, সেফটি, সিকিউরিটি ও এনভায়রনমেন্ট (HSSE) নীতিমালা প্রয়োগ করবে, যা দুর্ঘটনার হার কমিয়ে কর্মীদের কল্যাণ নিশ্চিত করবে।
৬. আধুনিক প্রযুক্তি স্থানান্তর: এপিএম উন্নত ডিজিটাল টার্মিনাল অপারেটিং সিস্টেম, LEAN পদ্ধতি ও FLOW প্রসেস ফ্রেমওয়ার্ক বাংলাদেশের বন্দর অবকাঠামোকে আধুনিক করবে এবং স্থানীয় প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদদের দক্ষতা বৃদ্ধি করবে।
৭. ব্যবসায়িক ব্যয় হ্রাস ও দ্রুত সরবরাহ: দ্রুত জাহাজ turnaround time ও কম container dwell time এর মাধ্যমে রপ্তানিকারকরা, বিশেষ করে পোশাক, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও হালকা প্রকৌশল খাতের উদ্যোক্তারা সময়মতো সরবরাহ দিতে সক্ষম হবেন, যা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্তিশালী করবে।
৮. কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়ন: এপিএম টার্মিনালসের নিজস্ব প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ ও ব্যবস্থাপকরা আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ পাবেন, যা দেশের সামগ্রিক লজিস্টিক খাতের দক্ষতা বৃদ্ধি করবে।
৯. অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক প্রবাহ বৃদ্ধি: বন্দরটির বার্ষিক ৮ লক্ষাধিক টিইইউ মালবাহী সক্ষমতা ঢাকা-চট্টগ্রাম ও অন্যান্য অর্থনৈতিক করিডোরে নতুন ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো, কোল্ড চেইন ও শিল্পাঞ্চল স্থাপনে উৎসাহ দেবে।
১০. সবুজ ও জলবায়ু-সহনশীল বন্দর অবকাঠামো: জ্বালানি দক্ষ প্রযুক্তি ব্যবহার ও জলবায়ু অভিযোজন উদ্যোগের মাধ্যমে বন্দরটির কার্বন নির্গমন হ্রাস পাবে এবং তা বাংলাদেশের প্যারিস চুক্তির (NDC) লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সহায়ক হবে।
১১. বাংলাদেশের পিপিপি খাতের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন: একটি বৈশ্বিক মানের দীর্ঘমেয়াদি কনসেশন চুক্তি বাংলাদেশের পিপিপি সক্ষমতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করবে, যা ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ, পরিবহন ও সামাজিক অব বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করবে।
2/4
প্রেস বিফ্রিং এর শেষ দিকে জনাব আশিক চৌধুরী আরো বলেন, “লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্পটি বাংলাদেশের বন্দর খাতকে বিশ্বমানের পর্যায়ে নিয়ে যাবে। এটি কেবল একটি অবকাঠামো বিনিয়োগ নয় বরং বাংলাদেশের লজিস্টিকস খাতকে ‘ফিউচার-রেডি’ করে তুলবে, যা আমাদের রপ্তানি, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করবে।”
নিজস্ব সংবাদ : 



















