
কোটা সংস্কার আন্দোলন-২০২৪ ও অসহযোগ আন্দোলন-২০২৪ এর সমন্বিত আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায় জুলাই গণঅভ্যুত্থান । এ জন্যই জুলাই মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক, যা ২০২৪ জুলাইয়ের আগেও ছিল না। কারণ, জুলাইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গণঅভ্যুত্থান যার মাধ্যমে বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটেছে। যে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পতন ঘটে ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী শাসনের। জুলাই-২০২৫ বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার কাছে নতুন বাংলাদেশের নাম। স্বাধীনচেতা বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের কাছে যে জুলাইয়ের অপেক্ষা ছিল গত ১৫ বছরের। ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের শুরু হয়েছিল এই জুলাইয়ে। অকুতোভয় ছাত্র-জনতা, শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ, বয়স সব ভেদাভেদ মুছে দিয়ে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিল। জাতির সম্মিলিত প্রতিরোধ নাড়িয়ে দিয়েছিল স্বৈরশাসকের ভিত্তিমূল। তাই আজকের এই জুলাই একটি নতুন সূর্য, ভিন্ন এক জুলাইয়ের গল্প। যে জুলাই আর কখনোই আসেনি।
আন্দোলনের সূচনা হয় ২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ একটি ঐতিহাসিক রায় দেয়, যেখানে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করা হয় । এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। তারা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে একটি আন্দোলনের ডাক দেয় এবং তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মোড় আসে যখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে?” এই মন্তব্য আন্দোলনকারীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে “তুমি কে, আমি কে/রাজাকার, রাজাকার” স্লোগান ওঠে ।
পরদিন ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ কে আঘাত করার অভিযোগ আনেন। একই দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। সেইসাথে পুলিশও লাঠি, রাবার বুলেট দিয়ে হামলা করে। এসব হামলায় ১৬ জুলাই থেকে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। পরিস্থিতি সহিংস রূপ নেয় যখন ছাত্রলীগ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালায়। ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন, যা পুরো দেশে আন্দোলনকে আরও উসকে দেয় ।
২৯ জুলাই চূড়ান্ত সংঘর্ষে ঢাকা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের হামলা হয়, যা শিক্ষার্থীদের ক্রোধকে আরও উসকে দেয়। এরই মাঝে দেশটির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয় সরকার। সারাদেশে ইন্টারনেট প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো থেকে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সরকারের বিরোধিতা করার অভিযোগে প্রায় সকল জেলায় পুলিশ গণ-গ্রেফতার চালায় ও হাজার হাজার মানুষকে আটক করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন কিছু না কিছু মানুষ নিহত হতে থাকে। এ আন্দোলন ছাত্র, জনতা, পথচারী, শিশুসহ প্রায় দুই হাজারের অধিক মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। কোথাও কোথাও চোরাগোপ্তা হামলা ও অগ্নিসংযোগের মত ঘটনা ঘটতে থাকে।
আমরা দেখেছি অনেক মা রাস্তায় আন্দোলনরত কোমলমতিদের পানি খাওয়াচ্ছেন, এক মা ভাত মেখে রাস্তায় দৌড়ে দৌড়ে তাদের মুখে ভাত তুলে দিচ্ছেন। অনেকে আবার বাসার সামনে খাবার পানির বোতল বিস্কুট রেখে দিয়েছে আন্দোলনকারীদের জন্য। দেশে ব্যাপী মানুষের ঘোর কাটে যখন তারা শুনতে পায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক প্রফেসর গোলাম রাব্বানী স্যারের কণ্ঠে নবরুন ভট্টাচার্যের আবৃতি করা সেই হৃদয়বিদারক কবিতা । ‘যে পিতা সন্তানের লাশ শনাক্ত করতে ভয় পায়, আমি তাকে ঘৃণা করি। যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে, আমি তাকে ঘৃণা করি’ – যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানি, প্রকাশ্য পথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না, আমি তাকে ঘৃণা করি –। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সাইমা ফেরদৌস এর বক্তব্য যা সারা দেশের মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছিল। ‘মনে হয় রাস্তায় শহিদ হয়ে গেলে এই লজ্জা আমার কিছুটা কাটে। বাবা মায়ের আর্তনাদ, অভিশাপ আসমান কাপে। আপনাদের কাপে না? যারা ভয়ে আছেন ভয়ে থাকেন একটা মারবেন ১০ টা আসবো, ১০ মারবেন লক্ষটা আসবো,সারা দেশের মানুষ মা-বাপ সবাই আসবো।‘ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর বক্তব্য ‘বাবাকে বলে আসছি, যদি মরে যাই, বিজয়ের পর যেন আমার লাশ দাফন করা হয়’।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হওয়ার পর, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। এরপর রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ পরপর আরও তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জয় লাভ করে। নির্বাচনগুলোতে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। ২০১৮ সালের নির্বাচন ব্যতীত বাকি দুটো নির্বাচন বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বয়কট করেছিলো। এসময় সরকার তাদের বিরোধীদের উপর ব্যাপক নির্যাতন ও ধর-পাকড় চালায়, বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের বিভিন্ন মামলায় সাজা দেওয়ার মাধ্যমে তাদের নেতৃত্বশূন্য করে ফেলা হয়। এইসময়ে বাংলাদেশের সব গণমাধ্যমে তথ্য প্রচার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর মতো আইনের মাধ্যমে কঠোরভাবে জনসাধারণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে প্রবল জনরোষের মুখে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং তার ছোটো বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে ভারতের দিল্লিতে পালিয়ে যান । তার পতনের দিন ঢাকাসহ সারাদেশে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এবং আনন্দ প্রকাশ করে । এর পরে একে একে দেশ ছেড়েছেন প্রায় সকল মন্ত্রী, এমপি, উপজেলা ও ইউপি চেয়ারম্যান এমনকি মসজিদের ইমাম।
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন একটা স্থবির অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে। একটা রাষ্ট্রকে সচল রাখার জন্যে জনগণের যে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকে সেটা প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছিল। এর প্রধান কারণ শুধু এক ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের কোনো স্বাধীনতা থাকে না। সেই স্বাধীনতা চলাফেরা, ব্যবসাবাণিজ্য, ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলা বা লেখার অধিকার, বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায় ইত্যাদি যেকোনো ক্ষেত্রেই বাধাপ্রাপ্ত হতে বাধ্য। নিজ দল ও আত্মীয়স্বজনের বাইরে রাষ্ট্রের যেকোনো ক্ষেত্রে কারোর কোনো বিষয়ে প্রবেশাধিকার ছিল না। গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া সবাই যেন নিজ দেশে পরবাসী।
হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশ তিন দিন সরকারবিহীন অবস্থায় থাকে। ৮ আগস্ট দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। এই সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার কার্যক্রম শুরু করে এবং ২০২৬ সালের এপ্রিলে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দেয় ।
এইসময়ে অরাজনৈতিক আন্দোলনসহ অধিকাংশ আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন বিশেষত ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করতো। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে সহিংসতামূলক কর্মকাণ্ড ও দমন-নিপড়নের অভিযোগ ছিলো। গত তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগের ছোটো থেকে কেন্দ্রের বেশিরভাগ নেতা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থপাচারের অভিযোগ উঠেছিলো, বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থে কানাডায় বাংলাদেশিদের পরিবারের সদস্যদের বেগমপাড়া তৈরি করা হয়েছে।
তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ছুঁয়েছে, পাশাপাশি রিজার্ভের ঘাটতি, দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার, দেশ থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ পাচার, ব্যাংকিং খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের জন্য সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে দিনে দিনে জীবনযাপন কঠিন হয়ে উঠেছিলো, যার কারণে তারা সরকারের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল।
এই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের যারা শহিদ হয়েছেন, তাদের আত্মত্যাগ বিশেষভাবে আলোচনার দাবি রাখে। তাদের পরিচিতি এবং জীবন কাহিনি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা। তাঁদের মধ্যে রয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থী, যাদের জীবন বিসর্জনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। শহিদদের স্মরণে এই বিপ্লব একটি চিরন্তন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
জুলাই-পরবর্তী আমরা দেখতে পাই, শত বিভেদ সত্ত্বেও রাষ্ট্রের যেকোনো অসুবিধার সময় দলমতনির্বিশেষে সবাই একত্রিত হয়ে যায়। ভবিষ্যতে পরিবর্তিত বাংলাদেশকে একটি নতুন বাংলাদেশ হিসেবে আমরা দেখতে পারব। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রদের অন্যতম মূল লক্ষ্য ছিল, আমাদের আর বিদেশমুখী হতে হবে না, বরং বিদেশিরাই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে আসবে। ৩৬ দিনের এই আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত নতুন বাংলাদেশকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি নতুন অবয়বে বাংলাদেশকে গড়ে তুলবে।
#
লেখক: মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন
সিনিয়র তথ্য অফিসার ও জনসংযোগ কর্মকর্তা,
ভূমি মন্ত্রণালয়