
বাংলাদেশে ব্যক্তিগত আয়কর আদায়ের সবচেয়ে সহজ উৎস হলো বেতনভুক্ত চাকরিজীবীরা। এর কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেতন সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে দেওয়া হয়, অফিস থেকেই উৎসে কর (TDS) কেটে রাখা হয়, এবং অফিসগুলোই কর রিটার্ন জমা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে। ফলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কোনো অতিরিক্ত প্রচেষ্টা ছাড়াই একটি বড় অঙ্কের রাজস্ব সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়।
অর্থবছর ২০২৫–২৬ ও ২০২৬–২৭ এর ব্যক্তিগত আয়কর হারের তুলনা
অর্থবছর ২০২৫–২৬
- প্রথম ৩,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত: ০%
- পরবর্তী ১,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত: ৫%
- পরবর্তী ৪,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত: ১০%
- পরবর্তী ৫,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত: ১৫%
- পরবর্তী ৫,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত: ২০%
- পরবর্তী ২০,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত: ২৫%
- ৩৮,৫০,০০০ টাকার বেশি: ৩০%
অর্থবছর ২০২৬–২৭
- প্রথম ৩,৭৫,০০০ টাকা পর্যন্ত: ০%
- পরবর্তী ৩,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত: ১০%
- পরবর্তী ৪,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত: ১৫%
- পরবর্তী ৫,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত: ২০%
- পরবর্তী ২০,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত: ২৫%
- ৩৮,৫০,০০০ টাকার বেশি: ৩০%
পরিবর্তনের প্রভাব: মধ্যবিত্তের ওপর বাড়তি চাপ
সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো ৫% কর স্ল্যাবটি সম্পূর্ণ তুলে দেওয়া হয়েছে, যা সরাসরি মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। এটি এক ধরনের “নীরব কর বৃদ্ধি” (silent tax hike), যেখানে করের হার সরাসরি না বাড়িয়েও প্রকৃত করের বোঝা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
উদাহরণটি এই পরিবর্তনকে আরও স্পষ্ট করে তোলে:
আগে অর্থবছর ২০২৫–২৬
: ৪,৫০,০০০ টাকা আয় করলে কর হতো ৫,০০০ টাকা।
- প্রথম ৩,৫০,০০০ টাকা: করমুক্ত।
- পরবর্তী ১,০০,০০০ টাকা: ৫% হারে ৫,০০০ টাকা।
এখন অর্থবছর ২০২৬–২৭: একই আয়ের জন্য কর হবে ৭,৫০০ টাকা।
- প্রথম ৩,৭৫,০০০ টাকা: করমুক্ত।
- পরবর্তী ৭৫,০০০ টাকা: ১০% হারে ৭,৫০০ টাকা।
এই পরিবর্তনের ফলে বেতনভুক্ত কর্মচারীদের করের বোঝা বেড়ে যাবে, কারণ তাদের কর উৎস থেকে কর্তন করা হয় এবং কর ফাঁকির কোনো সুযোগ থাকে না। অন্যদিকে, স্বাধীন পেশাজীবী ও অনানুষ্ঠানিক খাতের কর ফাঁকির সুযোগ আগের মতোই থেকে যাবে।
ন্যায্যতার প্রশ্ন ও প্রস্তাবনা
প্রশ্ন হলো— সরকার কি এমন একটি কর কাঠামো তৈরি করছে, যেখানে সহজ লক্ষ্যবস্তু অর্থাৎ চাকরিজীবীরাই মূলত করের বোঝা বহন করবে, আর জটিল উৎস থেকে কর সংগ্রহে তেমন উদ্যোগ নেওয়া হবে না?
বাংলাদেশে কর আদায়ের সবচেয়ে সহজ উৎস হলো বেতনভুক্ত মানুষ। অথচ সবচেয়ে বেশি কর ফাঁকি হয় ব্যবসা ও পেশাজীবী খাতে, যা পর্যাপ্ত নজরদারি ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে রোধ করা সম্ভব। একটি ন্যায্য ও টেকসই কর কাঠামোর জন্য শুধুমাত্র হার ও স্ল্যাব পরিবর্তন নয়, বরং কর ব্যবস্থার দর্শনকে আরও সমতাভিত্তিক করা প্রয়োজন।
এই লক্ষ্য অর্জনে প্রস্তাবনা:
- মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য প্রথম দুটি স্ল্যাবের হার কম রাখা উচিত।
- ন্যূনতম করের বাধ্যবাধকতা কম আয়ের মানুষের জন্য শিথিল করা।
- কর ফাঁকি রোধে ডিজিটাল ট্র্যাকিং ও তৃতীয় পক্ষের তথ্যভাণ্ডার ব্যবহার করে উচ্চ আয়ের কিন্তু কর না দেওয়া শ্রেণিকে করের আওতায় আনা।
- কর সংস্কার এমন হতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ আস্থা পায় যে তাদের দেওয়া করের অর্থ সুষ্ঠুভাবে জনকল্যাণে ব্যয় হচ্ছে।
চলমান আয়কর স্ল্যাব পরিবর্তন একটি নিঃশব্দ করবৃদ্ধি। এটি যেন করের ভার সুষমভাবে বণ্টনের নীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে। ন্যায্য, টেকসই ও বাস্তবমুখী করনীতি গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
রেজাউল আশরাফ
কর আইনজীবী