
আজ ৬ আগস্ট বুধবার দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটে মগবাজার আল-ফালাহ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে ৫ আগস্ট মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক ঘোষিত ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ এবং জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণ সংক্রান্ত বিষয়গুলোর ওপর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া উপস্থাপন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার; সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম, ড. হামিদুর রহমান আযাদ (সাবেক এমপি), মাওলানা আবদুল হালিম, এড. মুয়াযযম হোসাইন হেলাল এবং এড. এহসানুল মাহবুব জুবায়ের (প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান); কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য জনাব সাইফুল আলম খান মিলন, এড. মতিউর রহমান আকন্দ (প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি), জনাব আবদুর রব, জনাব মোবারক হোসাইন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর জনাব মো. সেলিম উদ্দিন, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় অফিস সেক্রেটারি মাওলানা আফম আবদুস সাত্তার প্রমুখ।
জনাকীর্ণ এ সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ও সাবেক সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের সংগঠনের পক্ষে একটি লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
প্রদত্ত বক্তব্যটি দেশবাসীর অবগতির জন্য নিচে প্রকাশ করা হলো:
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
আজকের এই সাংবাদিক সম্মেলনে আমি আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি।
আপনারা জানেন, বিগত ১৬ বছরের জুলুম, নিপীড়ণ, গুম-খুন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে ২০২৪ এর জুলাই-আগস্টে ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা অনেক স্বৈরশাসকের পতন দেখেছি, অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে জনতার অনেক সংগ্রাম দেখেছি, কিন্তু বাংলাদেশের ২৪ এর সরকার পতনের যে দৃশ্য, সেটা একেবারেই ব্যতিক্রম। এই কৃতিত্ব জনগণেরই। সকল রাজনৈতিক দল, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, মাদরাসার শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবক, হকার, শ্রমিক শেষ দিকে জুলাইতে এসে আন্দোলনটা এমন একটা সার্বজনীন রূপ লাভ করে যা আগে কখনো দেখা যায়নি। বাংলাদেশে আর যেন ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে, আবারো যেন সেই দুঃশাসন ফিরে আসতে না পারে, দেশে ইনসাফপূর্ণ, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ কায়েম হবে- সেই আকাঙ্ক্ষা ছিল জনগণের। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সভা-সমাবেশ করার অধিকার, বাক স্বাধীনতা, ভোটাধিকার নিশ্চিত হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে আপামর জনসাধারণ। সেই প্রত্যাশাকে সামনে রেখেই জনগণ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়িত্ব দিয়েছে। জুলাই আন্দোলন সংগ্রামের ঘটনাকে ধারণ করে জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই জাতীয় সনদের দাবি সর্বমহলের। এ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে দীর্ঘ সংলাপ করেছে।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় গতকাল ৫ আগষ্ট অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ২৮ দফার জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণাপত্র একটি অপূর্ণাঙ্গ বিবৃতি। এতে গণমানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি। ঘোষণাপত্রে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের কথা বলা হলেও ১৯৪৭ এর আজাদীকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এতে পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা হত্যাকাণ্ড, ২৮ অক্টোবরের হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ নেই। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আলেম-ওলামা, মাদ্রাসা শিক্ষক ও ছাত্র, প্রবাসী ও অনলাইন এক্টিভিস্টদের ভূমিকার উল্লেখ নেই; যা ইতিহাসের প্রতি অবিচার ও অবহেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। জুলাই অভ্যুত্থানের টার্নিং পয়েন্ট ছিল ৯ দফা যা এক দফায় রূপান্তরিত হয়েছিল; সে বিষয়টিও ঘোষণাপত্রে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রধান আকাঙ্ক্ষা ছিল রাষ্ট্র সংস্কার। এ জন্য ৬টি কমিশন গঠন এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে দু’পর্বের দুই মাসেরও অধিক কাল যে কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে এবং ১৯টি বিষয়ে ঐকমত্যের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে। অথচ প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক পঠিত জুলাই ঘোষণাপত্রে তার উল্লেখ নেই। ঘোষণায় কখন কীভাবে তা কার্যকর করা হবে তা উল্লেখ না করে ঘোষণাকে গুরুত্বহীন করা হয়েছে। পরবর্তী সরকারের হাতে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়ায় হাজার হাজার মানুষের আত্মত্যাগ, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত জুলাই চেতনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা ও ইনসাফ ভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে সংস্কার, গণহত্যার বিচার ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত নির্বাচনের টাইমলাইন (ডিসেম্বর-জুন) শর্ত সাপেক্ষে সমর্থন দিয়ে আসছে।
আমাদের প্রত্যাশা ছিল প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করবেন। তা না করায় জাতি হতবাক ও বিস্মিত হয়েছে। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পূর্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করার দীর্ঘ দিনের যে ঐতিহ্য তা উপেক্ষা করে জুলাই ঘোষণার দিনেই নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করা হয়েছে। তথাপি জাতীয় স্বার্থে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একটি নির্বাচনমুখী দল। অতীতে সকল গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর অংশগ্রহণ ও জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল। সারা দেশে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী প্রস্তুতি চলছে। আমরা লক্ষ্য করছি নির্বাচনের উপযুক্ত যে পরিবেশ থাকার কথা ছিল তা সরকার এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি। এজন্য প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত টাইমলাইন অনুযায়ী অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে তার আইনি ভিত্তি দিতে হবে। অতীতে বিভিন্ন অভ্যুত্থান ও আন্দোলন হয়েছে- পরবর্তী সময়ে তার আইনিভিত্তি দেওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন- ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর লিগাল ফ্রেম ওয়ার্ক এর ভিত্তিতে ৭০-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদে ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুমোদন হয়েছিল।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ১০ মাস মুজিবনগর সরকারের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা এবং স্বাধীনতার পরবর্তী সরকার গঠনের পূর্ব পর্যন্ত ৭৫ এর পটপরিবর্তনের পর এবং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ ও দেশ পরিচালনা, দল গঠন, সামরিক প্রশাসক থেকে প্রেসিডেন্ট এর দায়িত্ব গ্রহণসহ ৭৫ থেকে ৭৯ পর্যন্ত শাসনকালের গণভোট, অধ্যাদেশ জারি করে তার ক্ষমতায় আরোহন ও দেশ পরিচালনার মত বৈধতা দিয়েছিল যা পরবর্তী সংসদ অনুমোদন করে। উপরন্তু ১৯৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের পর তিন জোটের রূপরেখার ভিত্তিতে বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও তার আইনি ভিত্তি না থাকায় এ রূপরেখার অন্যান্য বিষয়গুলো বাস্তবায়ন হয়নি। অতীতে এত নজির থাকার পরও এখন জুলাই জাতীয় ঘোষণাপত্রের আইনি ভিত্তি দিতে বাধা কোথায়?
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ
আমাদের আকাঙ্ক্ষা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পূর্বে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন দ্রুত সম্পন্ন করে অধ্যাদেশ, এলএফও বা গণভোট এর মাধ্যমে আইনি ভিত্তি প্রদান করা না হলে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম বিফলে যাবে। তাই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বাহিনী ও সংস্থার কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার ও প্রশাসনের মধ্যে স্বৈরাচারের দোসরদের মুক্ত করতে হবে। নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনের সকল স্তরে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
বাংলাদেশের আপামর জনতা জুলাই জাতীয় ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে যে প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করছিল তা পূরণ না হওয়ায় জনগণের মাঝে দেশের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। শহীদ ও আহতদের পরিবারসহ জুলাই যোদ্ধাদের মাঝে নতুনভাবে উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের রূপরেখা কী হবে তা জাতির কাছে অস্পষ্ট। এমতাবস্থায় আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই, অনতিবিলম্বে জুলাই ঘোষণাপত্রে উপরে উল্লেখিত জনআকাঙ্ক্ষার অপরিহার্য বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
সেই সাথে আরও দাবি জানাই, বাংলাদেশের অতীতের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে অবিলম্বে জুলাই জাতীয় সনদের প্রণয়নের কাজ সুসম্পন্ন করে বর্তমান সরকারকেই তা বাস্তবায়ন করতে হবে এবং এই সনদের ভিত্তিতে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
ধৈর্য সহকারে আমার বক্তব্য শোনার জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আপনাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
পঠিত বক্তব্যের বাইরে ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোঃ তাহের বলেন, আপনারা জানেন, মাননীয় আমীরে জামায়াত জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে আমাদের অবস্থান দীর্ঘদিন ধরেই স্পষ্ট করে তুলে ধরছেন। গত ১৬ এপ্রিল তিনি সাংবাদিকদের সামনে বলেছিলেন, রোজার আগে, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তা অধিকতর উপযুক্ত হবে। আমরা মনে করি, প্রধান উপদেষ্টা গতকাল জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য তারিখ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্ধারণের ঘোষণা দিয়েছেন, তা আমীরে জামায়াতের সেই সময়োপযোগী প্রস্তাবেরই প্রতিফলন। আমরা এ ঘোষণাকে ইতিবাচকভাবে দেখছি।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক ঐতিহ্য রয়েছে। সেটি হচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগে সরকারপ্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করে থাকেন। এমনকি নির্বাচন কমিশনও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। আমরা আশা করি, সরকার ও নির্বাচন কমিশন সেই গণতান্ত্রিক ও পরম্পরাগত প্রক্রিয়াকে সম্মান জানিয়ে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যথাযথ পরামর্শ করবেন।
এ সময় ডা. তাহের সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।